সালাম সালেহ উদদীন
বিশ্বব্যাপী এক মহাতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস। যতই দিন যাচ্ছে বিশ্বে করোনা সংক্রমণ ও মৃতু্য দুটোই বেড়েছে। বাংলাদেশেও সংক্রমণ ও মৃতু্য দুটোই বেড়েছে। যার কারণে সারাদেশে আবার উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে নিজেদের সক্ষমতা নির্ণয়ের পাশাপাশি সতর্কতামূলক প্রচার-প্রচারণায় জোর দিচ্ছে সরকার। গণপরিবহণ থেকে শুরু করে সর্বত্র যেন মাস্ক ব্যবহার করা হয় সে জন্য সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হচ্ছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ইতিমধ্যে মাঠ প্রশাসনকে সচেতনতামূলক প্রচারণা এবং মাস্ক পরতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার নির্দেশনা দিয়েছে। মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকশ লোককে জরিমানা করা হয়েছে। ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ বাস্তবায়নের জন্য সচিবালয়সহ সরকারি দপ্তরগুলোতে পোস্টার/ব্যানার সাঁটানো হয়েছে। মাস্ক পরায় উৎসাহিত করছেন কর্মকর্তারা। বার বার বলার পরেও করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে যারা মাস্ক পড়ছেন না, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদের ‘কঠিন সাজা দেওয়া হবে’ বলে হুঁশিয়ার করেছে সরকার। যারা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবে তারা মাস্কও সঙ্গে নিয়ে যাবে। যাতে মানুষকে ফাইন করার সঙ্গে সঙ্গে ওটাও দিয়ে দেয়া যায়।
উলেস্নখ্য, করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে গত জুলাই মাসের শেষ দিকে বাসার বাইরে সব জায়গায় সবার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করে সরকার। সবার মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন জেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানাও করা হচ্ছে। এবার পরিচালিত হচ্ছে রাজধানী ঢাকায়। অতি সংক্রামক এ ভাইরাস প্রতিদিনই মানুষের মৃতু্য ডেকে আনলেও নানা অজুহাতে এখনো অনেকে মাস্ক ব্যবহার করছেন না। এ ধরনের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক।
সারা বিশ্বে মহামারি হয়ে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস প্রতিরোধে লকডাউনের চেয়েও সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হলো মাস্ক ব্যবহার করা। কারণ করোনাভাইরাস মূলত বাতাসে ডপলেটস বা মুখ থেকে নিঃসৃত মিহি জলকণার মাধ্যমে ছড়ায়। আর মাস্ক ব্যবহার করলে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায় বলে এক গবেষণায় বলা হয়েছে।
আমাদের দেশের জনগণ মাক্স পরার ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। সরকারি নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তারা কেন মাস্ক পরছে না সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। মাস্ক পরা ছাড়া যে যার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাস্তায় বের হলেই এ ধরনের দৃশ্য চোখে পড়ে। দেশের সব জায়গায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় অন্য বিকল্প নেই।
শীত মৌসুম শুরুর আগেই বাড়তে শুরু করেছে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। আক্রান্ত বাড়ায় মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে দেখা যাচ্ছে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের শয্যা (আইসিইউ) সংকট। বেসরকারি হাসপাতালেও আইসিইউ শয্যা অপ্রতুল। দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর আগেই হাসপাতালে আইসিইউ সংকটের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। শীতকালে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর করোনাকালে আইসিইউ সংকট শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেই আছে। আমাদের জেলা পর্যায়ে ১০ শয্যা বিশিষ্ট আইসিইউ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এটা দ্রম্নত বাস্তবায়ন করতে হবে। সংকট সময়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সঙ্গে সরকার আইসিইউ নিয়ে চুক্তি করতে পারে। এতে সংকট যেমন কাটবে তেমনই মানুষের আর্থিক খরচও কমবে। তবে আইসিইউ সংখ্যা বাড়াতে হলে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবলেরও প্রয়োজন। এ জন্য সরকারকে প্রশিক্ষিত জনবলও নিয়োগ দিতে হবে। ঢাকা মহানগরীতে করোনা রোগীদের জন্য মোট আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৩০৯টি। এর মধ্যে ফাঁকা রয়েছে ৯২টি। চট্টগ্রামে করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৩৯টি। এর মধ্যে ফাঁকা রয়েছে ২৩টি। সারাদেশে আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৫৫৯টি। এর মধ্যে রোগী ভর্তি রয়েছে ২৯৪ জন, ফাঁকা রয়েছে ২৬৫টি আইসিইউ শয্যা।
শীতে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে যে শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে, বাংলাদেশে তেমন প্রভাব পড়বে না বলেই মনে হচ্ছে। আমরা যদি সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, বিশেষ করে মাস্ক পরাতে সরকার সবাইকে বাধ্য করে তাহলে করোনা সংক্রমণ উচ্চমাত্রায় পৌঁছার আশঙ্কা কম।
কিন্তু এখন পর্যন্ত মানুষকে মাস্ক পরানোই যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। সারা বিশ্বই এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি। মহামারি করোনাভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বিশ্ব অর্থনীতিও টালমাটাল। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে প্রত্যেকটি খাত। মানুষের জীবনযাপনের স্বাভাবিকতাও ব্যাহত হয়েছে। পৃথিবী থেকে কবে করোনা দূর হবে এ কথাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।
এ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত কার্যক্রমে সুশাসনের প্রতিটি নির্দেশকের ক্ষেত্রে এখনো ব্যাপক ঘাটতি বিদ্যমান। স্বাস্থ্য খাতে ইতিমধ্যে গভীরভাবে বিস্তৃত দুর্নীতি করোনা সংকটে প্রকটভাবে উন্মোচিত হয়েছে এবং করোনা সংকটকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। করোনা মোকাবিলায় সরকারের কিছু কার্যক্রমে উন্নতি হলেও আগের গবেষণার ধারাবাহিকতায় করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত কার্যক্রমে সুশাসনের প্রতিটি নির্দেশকের ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি এখনো বিদ্যমান। করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা, ত্রাণ কার্যক্রমে সংকট এখনো চলমান। সংঘটিত এ সব অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে স্বাস্থ্য খাতের ওপর মানুষের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। একইভাবে সরকারের ত্রাণসহ প্রণোদনা কর্মসূচি থেকেও অনিয়ম-দুর্নীতি ও সুবিধা লাভের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। মাঠপর্যায়ের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বিতরণকৃত ত্রাণ থেকে প্রকৃত উপকারভোগীরা বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারের সংকোচনমূলক নীতি প্রয়োগের (সেবা ও নমুনা পরীক্ষা হ্রাস) মাধ্যমে শনাক্তের সংখ্যা হ্রাস হওয়াকে ‘করোনা নিয়ন্ত্রণ’ হিসেবে দাবি এবং রাজনৈতিক অর্জন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ অভিযোগগুলো আমলে নেওয়া উচিত। কারণ করোনাভাইরাস মোকাবিলায় অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হয়েছে। তারা সঠিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সরকারের উচিত করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় এ সব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা। পাশাপাশি সব ধরনের অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়েছিল গত ৮ মার্চ, এরপর থেকে করোনার সংক্রমণ ও সংক্রমণে মৃতু্যর সংখ্যা বাড়ছেই। এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে আক্রান্ত হয়েছে ৫ কোটি ৯২ লাখ এবং মারা গেছে ১৩ লাখ ৯৭ হাজার। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার এবং মারা গেছে ৬ হাজার ৪৪৮ জন। সরকার তৎপর ও মনোযোগী হলে এবং দেশের মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে, দেশ আক্রান্ত ও মৃতু্যর দিক থেকে বিপজ্জনক পর্যায়ে যাবে না বলে আমাদের বিশ্বাস।